ভালো থাকুক মন
রেহানা পারভীন রুমা
‘মন ভালো নেই, মন ভালো নেই, মন ভালো নেই/কেউ তা বোঝে না সকলি গোপন মুখে ছায়া নেই/চোখ খোলা তবু চোখ বুজে আছি কেউ তা দেখেনি’—সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের অত্যন্ত জনপ্রিয় এ কবিতার মতো মন ভালো না থাকায় এক আশ্চর্য ছটফটানি এলোমেলো করে দেয় আমাদের ব্যক্তিজীবনকে। সবাই তো আর সৃজনশীলতার কল্যাণে নিজেকে ব্যক্ত করে পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে পারেন না। অধিকাংশের জীবন তাই নেতিবাচকতায় ও দুঃখ বিলাসের নৌকায় চেপে ভাসতেই থাকে এক অচেনা নদীতে। মন মাঝির হাতে হাল তুলে দিয়ে জীবনের হিসাবটাকে এলোমেলো করে ফেলায় কি কোনো লাভ আছে? বোধহয় নেই। কারণ আধুনিক চিকিত্সাশাস্ত্র বলছে মন নিয়ন্ত্রণ করো, শরীরও বসে থাকবে। ফলে জোর দেয়া হচ্ছে মনের সুস্থতায়, মনের পরিচর্যায়।
এক সময় মেন্টাল শব্দটা আমাদের দেশে মানসিক ভারসাম্যহীনতা বা ‘পাগল’র মতো শব্দের প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহার হতো। ‘পাগলের ডাক্তার’, ‘পাগলের হাসপাতাল’—এসব শব্দে যারা অভ্যস্ত হয়ে গেছেন তাদের পক্ষে মনের গতি-বৈচিত্র্য, মনের গভীরতা, মনের শক্তি অনুভব করা একটু কঠিন। তবে মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষার বিষয়টি আজকের প্রেক্ষাপটে এতটাই জরুরি হয়ে পড়ছে যে, গতানুগতিক ভাবনা থেকে বেরিয়ে না এসে উপায় নেই। একই সঙ্গে এ কথাও মনে রাখা দরকার যে, যারা নিজের আবেগ ও আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন তাদের পক্ষেই জীবনের নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা, সুদূর সম্পর্কের মধ্যে অবস্থান করে সৃজনশীল জীবনযাপন করা সম্ভব। একমাত্র তারাই পারেন যে কোনো প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ঘুরে দাঁড়াতে এবং উঠে আসতে। ফলে বিষণম্নতা ও উদ্বিগ্নতা অস্থিরতার মতো মনস্তাত্ত্বিক ইস্যুগুলোর উপস্থিতি, অনুপস্থিতির মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্যকে সংজ্ঞায়িত না করে একটু অন্যভাবে ভাবার সময় এসেছে। ব্যক্তির দৈনন্দিন জীবনে ইতিবাচকতার আলোকে মনের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করার প্রয়োজন বেড়েছে। কীভাবে বুঝবেন আপনি মানসিকভাবে একজন সুস্থ এবং স্বাস্থ্যবান ব্যক্তি? দেখে নিন আপনার মধ্যে এ গুণগুলো আছে কিনা।
--পরিতৃপ্তি, আপনার যা আছে তাই নিয়ে সন্তুষ্ট থাকার ক্ষমতা।
--উত্সাহ, আনন্দ, উচ্ছ্বাস, হাসতে পারা ও কাউকে আনন্দদানের ক্ষমতা।
--মানসিক চাপকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারা ও প্রতিকূল পরিস্থিতি থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষমতা।
--জীবনে সম্পর্ক, দায়িত্বের অর্থ ও উদ্দেশ্য যথাযথভাবে অনুভব করা।
--যে কোনো নতুন জিনিস শিখতে আগ্রহী হওয়া ও পরিবর্তনকে গ্রহণ করতে পারা।
--কাজ এবং বিশ্রামের ভারসাম্য তৈরি করতে পারা।
--আত্মবিশ্বাস ও আত্মসম্মানবোধ থাকা।
জীবনে সমস্যার শেষ নেই। প্রতিনিয়ত আমাদের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে সমস্যার পাহাড়, দৈনন্দিন দুর্ভোগ, সম্পর্কের টানাপোড়েন ও পেশাগত অস্থিরতা—যেন পদে পদে প্রতিকূলতার বেড়াজাল তৈরি করে আছে আমাদের জীবনে। কিন্তু এসব সমস্যার খপ্পরে পড়ে নিজের জীবনটাকে বিষিয়ে না তুলে কীভাবে সমস্যাকে পেরিয়ে সময়কে সুন্দরভাবে উপভোগ করা যায় তা বোধহয় একজন মানসিকভাবে সুস্থ মানুষের পক্ষেই ভাবা সম্ভব।
এক সময় মনকে প্রশান্ত ও আনন্দময় রাখার জন্য শরীরের সুস্থতার ওপর খুব জোর দেয়া হতো। আমরা এও জানি শারীরিক সুস্থতায় ব্যায়ামের জুড়ি নেই। ব্যায়াম হৃিপণ্ড বা ফুসফুসকে সুস্থ রাখার পাশাপাশি এনডরফিন হরমোনের নিঃসরণ ঘটিয়ে মনটাকেও চাঙা করে তোলে। একইভাবে আমরা কী চিন্তা করি, কী অনুভব করি এবং কীভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করি তার ওপরই নির্ভর করে শরীরের অনেক ক্রিয়াকলাপ। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, মানুষের মৃত্যু বা দুর্ঘটনা কোনো কারণে মানসিক চাপের মধ্যে থাকলে আমাদের রক্তচাপ বেড়ে যায় বা আমরা আলসারে আক্রান্ত হই। আজকের চিকিত্সাশাস্ত্র এও বলছে—ব্যাকপেইন, হজমের গণ্ডগোল, বুকে ব্যথা, কোষ্টকাঠিন্য বা ডায়রিয়া, গলা শুকিয়ে যাওয়া, অতিরিক্ত ক্লান্তি, গায়ে ব্যথা, মাথাব্যথা, অনিদ্রা, বুক ধড়ফড় করা, নিঃশ্বাসে সমস্যা, যৌন জীবনে সমস্যা, অতিরিক্ত ঘাম, ওজন অতিরিক্ত বৃদ্ধি বা হ্রাসসহ বেশকিছু রোগের মূল কারণ হচ্ছে মন। মানসিকভাবে চাপে থাকলে আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অকার্যকর হয়ে পড়ে। একইভাবে এ অবস্থায় শরীরের যত্ন নেয়ার প্রয়োজনীয়তা আমরা ভুলে যাই। আমরা একটু লক্ষ্য করলেই দেখতে পাব, এ ধরনের অসুস্থতার জন্য আমরা নিজেরাই দায়ী। কাজের পরিবেশ অনুকূল নয়। এ অনুভূতির কারণে অফিসে ঢুকতেই মাথাব্যথা শুরু হয়ে যায় অনেকের। যানবাহন পাবেন না, সময়মত সঠিক জায়গায় পৌঁছাতে পারবেন না—এই টেনশনে বুক ধড়ফড় করছে। অন্যজনের ‘কী হবে’—এ দুশ্চিন্তায় রাতের ঘুম নষ্ট হচ্ছে, এমনকি স্কুলে পড়াশোনার চাপ, টিচারের বকুনি খাওয়ার চিন্তা আজকাল শিশুর মধ্যেও গ্যাসিল্ট্রক সমস্যা, ক্ষুধামন্দা দেখা দিচ্ছে। জীবন সম্পর্কে, পরিবেশ-পরিস্থিতি সম্পর্কে নেতিবাচক চিন্তা ও প্রভাব আমাদের এভাবে অসুস্থ করছে প্রতিনিয়ত। কথা হচ্ছে, জীবনের মূল্যবান অথচ সীমাবদ্ধ সময়টুকুকে আপনি উপভোগ করবেন কিনা? উত্তরটা হ্যাঁ হলে তো কথাই নেই। আর যারা এ সত্যটুকু স্বীকার করতেও দ্বিধা করেন তাদের বোধহয় ভেবে দেখা উচিত এটা এক ধরনের স্বার্থপরতা। সৃষ্টিকর্তার প্রতি, প্রকৃতির প্রতি, কাছের মানুষের প্রতি দায়িত্বজ্ঞানহীনতার লক্ষণ। কারণ আপনার মানসিক অসুস্থতা অন্যকে পীড়িত করে, আপনার কর্মক্ষমতাকে বাধাগ্রস্ত করে, আপনার পারিপার্শ্বিকতাকে অস্থির করে তোলে, আপনি নিজের জীবনকে ভারাক্রান্ত করে তোলেন এবং অন্যের প্রত্যাশাকে আহত করেন। সময় নষ্ট না করে নিজের প্রতি মনোযোগী হয়ে দেখুন জীবন অনেক বেশি আনন্দময় এক অভিজ্ঞতা।
আজকের প্রেক্ষাপটে প্রত্যেকেই নিজের ও অন্যের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি যত্নবান হতে হবে। আর এজন্য প্রথমে নিজের আবেগকে চিহ্নিত করতে হবে। দুঃখ, উদ্বেগ, উত্কণ্ঠার কারণগুলো খুঁজে বের করতে হবে। যথাযথ পদ্ধতিতে কারও না কারও কাছে এ অনুভূতিগুলোর প্রকাশ ঘটাতে হবে। প্রিয়জন, বন্ব্দু, ডাক্তার, ধর্মের ভালো ব্যাখ্যা দিতে পারেন এমন কারও কাছেও কিন্তু আপনি মনের অবস্থা খুলে বলতে পারেন। মন খুলে মনের কথা বলার মাধ্যমে অনেক চাপ কমে যাবে। এ বলতে পারার অভ্যাসটা শুধু বড়রাই রপ্ত করলে হবে না, শিশুদের মধ্যেও এ অভ্যাসটা গড়ে দিতে হবে; যাতে করে অভিযোগ না, মনের অবস্থা-অনুভূতি প্রকাশের জন্য শিশু মা-বাবাকে আসল মানুষ ভাবতে পারে।
ভারসাম্যপূর্ণ জীবনযাপন মানসিক সুস্থতার অন্যতম হাতিয়ার। সমস্যা আছে বলে সেটাতে আচ্ছন্ন হয়ে পড়বেন না। এর অর্থ এই নয় যে, সমস্যার মধ্যেও ‘সুখী’ ‘সুখী’ ভাব করবেন। গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির দিকে দৃষ্টিপাত করা।
মনকে বশ করার চেষ্টা না করে তাকে কীভাবে প্রফুল্ল রেখে জীবনকে আনন্দময় করে তোলা যায় চলুন জেনে নেই সেরকম কিছু টিপস।
--স্বাভাবিকতা বজায় রাখুন, আপনি যা নিজেকে সেভাবেই প্রকাশ করুন। ময়ূরপুচ্ছ সৌন্দর্য দিতে পারে, কিন্তু এতে অন্যের সমর্থন, আত্মবিশ্বাস, আত্মসম্মান ক্ষুণম্ন হয়।
--অন্যকে বিশ্বাস করুন, নিজের ওপর বিশ্বাস রাখুন।
--নিজের পঞ্চ ইন্দ্রিয়কে আনন্দিত রাখুন। ভালো গান শুনুন, ভালো ছবি দেখুন। ফুলের গন্ব্দ নিন, লেবু দিয়ে পানি পান করুন। নিজের শরীরের যত্ন নিন।
--সৃজনশীল কাজ বা উদ্যোগের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখুন। বাগান করুন, ছবি আঁঁকুন, লেখা ছাপা না হলেও লিখুন।
--বিশ্রামের সময়টাকে মূল্য দিন। আড্ডা, প্রাণখুলে হাসি, ভালো বইপড়ার মতো অভ্যাসে ভরপুর সময় কাটান।
--একাকিত্ব মানসিক চাপ বাড়ায়। নিজেকে সামাজিক কর্মকাণ্ডে অন্তর্ভুক্ত করুন। প্রতিদিন অন্তত একজনের উপকার করার চেষ্টা করুন। অন্যের সমস্যা, অন্যের কষ্ট অনুভব করুন।
--টিভি আর কম্পিউটার—স্কিদ্ধনের বাইরের পৃথিবীকে দেখুন। মানুষের সঙ্গে সামনাসামনি যোগাযোগ, অন্যের অভিজ্ঞতা জানার চেষ্টা করুন।
--দৈহিক সৌন্দর্য যেমনই হোক না কেন, অন্তরের সৌন্দর্য উপলব্ধি করুন। নিজের প্রতি যত্নবান হোন, নিজেকে ভালোবাসুন।
--মনকে প্রশান্ত রাখুন। জীবনের আসল ছন্দ লুকিয়ে থাকে দমের মধ্যে। গভীরভাবে শ্বাস নিতে শিখুন। মেডিটেশন করুন। প্রশান্তির পদ্ধতি হিসেবে নিয়মিত মেডিটেশন করুন।
--নিজের ভালোলাগাকে মূল্য দিন। দৈনন্দিন কাজের ফাঁকে এমন কিছু করুন, যা একান্তই নিজের আনন্দের জন্য।
--পৃথিবীতে নিজের অবস্থানের জন্য কৃতজ্ঞ থাকুন। যেসব কারণে আপনি শুকুরিয়া আদায় করেন তা ভালো করে ভেবে দেখুন। ধর্মীয় আচার পালন করুন। সৃষ্টিকর্তা বিশাল এ প্রকৃতির অংশ হিসেবে আপনাকে সৃষ্টি করেছেন, সেই প্রকৃতির সঙ্গে একাত্মতা অনুভবের চেষ্টা করুন।
অস্থিরতা নয়, একাগ্রতার মাধ্যমে নিজের মানসিক সুস্থতা নিশ্চিত করুন। প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন। তবে কে না জানে আত্মশক্তির চেয়ে শক্তিশালী ওষুধ আর নেই। সেই ওষুধেই ভালো হয়ে যাক আপনার মন।
এক সময় মেন্টাল শব্দটা আমাদের দেশে মানসিক ভারসাম্যহীনতা বা ‘পাগল’র মতো শব্দের প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহার হতো। ‘পাগলের ডাক্তার’, ‘পাগলের হাসপাতাল’—এসব শব্দে যারা অভ্যস্ত হয়ে গেছেন তাদের পক্ষে মনের গতি-বৈচিত্র্য, মনের গভীরতা, মনের শক্তি অনুভব করা একটু কঠিন। তবে মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষার বিষয়টি আজকের প্রেক্ষাপটে এতটাই জরুরি হয়ে পড়ছে যে, গতানুগতিক ভাবনা থেকে বেরিয়ে না এসে উপায় নেই। একই সঙ্গে এ কথাও মনে রাখা দরকার যে, যারা নিজের আবেগ ও আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন তাদের পক্ষেই জীবনের নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা, সুদূর সম্পর্কের মধ্যে অবস্থান করে সৃজনশীল জীবনযাপন করা সম্ভব। একমাত্র তারাই পারেন যে কোনো প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ঘুরে দাঁড়াতে এবং উঠে আসতে। ফলে বিষণম্নতা ও উদ্বিগ্নতা অস্থিরতার মতো মনস্তাত্ত্বিক ইস্যুগুলোর উপস্থিতি, অনুপস্থিতির মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্যকে সংজ্ঞায়িত না করে একটু অন্যভাবে ভাবার সময় এসেছে। ব্যক্তির দৈনন্দিন জীবনে ইতিবাচকতার আলোকে মনের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করার প্রয়োজন বেড়েছে। কীভাবে বুঝবেন আপনি মানসিকভাবে একজন সুস্থ এবং স্বাস্থ্যবান ব্যক্তি? দেখে নিন আপনার মধ্যে এ গুণগুলো আছে কিনা।
--পরিতৃপ্তি, আপনার যা আছে তাই নিয়ে সন্তুষ্ট থাকার ক্ষমতা।
--উত্সাহ, আনন্দ, উচ্ছ্বাস, হাসতে পারা ও কাউকে আনন্দদানের ক্ষমতা।
--মানসিক চাপকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারা ও প্রতিকূল পরিস্থিতি থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষমতা।
--জীবনে সম্পর্ক, দায়িত্বের অর্থ ও উদ্দেশ্য যথাযথভাবে অনুভব করা।
--যে কোনো নতুন জিনিস শিখতে আগ্রহী হওয়া ও পরিবর্তনকে গ্রহণ করতে পারা।
--কাজ এবং বিশ্রামের ভারসাম্য তৈরি করতে পারা।
--আত্মবিশ্বাস ও আত্মসম্মানবোধ থাকা।
জীবনে সমস্যার শেষ নেই। প্রতিনিয়ত আমাদের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে সমস্যার পাহাড়, দৈনন্দিন দুর্ভোগ, সম্পর্কের টানাপোড়েন ও পেশাগত অস্থিরতা—যেন পদে পদে প্রতিকূলতার বেড়াজাল তৈরি করে আছে আমাদের জীবনে। কিন্তু এসব সমস্যার খপ্পরে পড়ে নিজের জীবনটাকে বিষিয়ে না তুলে কীভাবে সমস্যাকে পেরিয়ে সময়কে সুন্দরভাবে উপভোগ করা যায় তা বোধহয় একজন মানসিকভাবে সুস্থ মানুষের পক্ষেই ভাবা সম্ভব।
এক সময় মনকে প্রশান্ত ও আনন্দময় রাখার জন্য শরীরের সুস্থতার ওপর খুব জোর দেয়া হতো। আমরা এও জানি শারীরিক সুস্থতায় ব্যায়ামের জুড়ি নেই। ব্যায়াম হৃিপণ্ড বা ফুসফুসকে সুস্থ রাখার পাশাপাশি এনডরফিন হরমোনের নিঃসরণ ঘটিয়ে মনটাকেও চাঙা করে তোলে। একইভাবে আমরা কী চিন্তা করি, কী অনুভব করি এবং কীভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করি তার ওপরই নির্ভর করে শরীরের অনেক ক্রিয়াকলাপ। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, মানুষের মৃত্যু বা দুর্ঘটনা কোনো কারণে মানসিক চাপের মধ্যে থাকলে আমাদের রক্তচাপ বেড়ে যায় বা আমরা আলসারে আক্রান্ত হই। আজকের চিকিত্সাশাস্ত্র এও বলছে—ব্যাকপেইন, হজমের গণ্ডগোল, বুকে ব্যথা, কোষ্টকাঠিন্য বা ডায়রিয়া, গলা শুকিয়ে যাওয়া, অতিরিক্ত ক্লান্তি, গায়ে ব্যথা, মাথাব্যথা, অনিদ্রা, বুক ধড়ফড় করা, নিঃশ্বাসে সমস্যা, যৌন জীবনে সমস্যা, অতিরিক্ত ঘাম, ওজন অতিরিক্ত বৃদ্ধি বা হ্রাসসহ বেশকিছু রোগের মূল কারণ হচ্ছে মন। মানসিকভাবে চাপে থাকলে আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অকার্যকর হয়ে পড়ে। একইভাবে এ অবস্থায় শরীরের যত্ন নেয়ার প্রয়োজনীয়তা আমরা ভুলে যাই। আমরা একটু লক্ষ্য করলেই দেখতে পাব, এ ধরনের অসুস্থতার জন্য আমরা নিজেরাই দায়ী। কাজের পরিবেশ অনুকূল নয়। এ অনুভূতির কারণে অফিসে ঢুকতেই মাথাব্যথা শুরু হয়ে যায় অনেকের। যানবাহন পাবেন না, সময়মত সঠিক জায়গায় পৌঁছাতে পারবেন না—এই টেনশনে বুক ধড়ফড় করছে। অন্যজনের ‘কী হবে’—এ দুশ্চিন্তায় রাতের ঘুম নষ্ট হচ্ছে, এমনকি স্কুলে পড়াশোনার চাপ, টিচারের বকুনি খাওয়ার চিন্তা আজকাল শিশুর মধ্যেও গ্যাসিল্ট্রক সমস্যা, ক্ষুধামন্দা দেখা দিচ্ছে। জীবন সম্পর্কে, পরিবেশ-পরিস্থিতি সম্পর্কে নেতিবাচক চিন্তা ও প্রভাব আমাদের এভাবে অসুস্থ করছে প্রতিনিয়ত। কথা হচ্ছে, জীবনের মূল্যবান অথচ সীমাবদ্ধ সময়টুকুকে আপনি উপভোগ করবেন কিনা? উত্তরটা হ্যাঁ হলে তো কথাই নেই। আর যারা এ সত্যটুকু স্বীকার করতেও দ্বিধা করেন তাদের বোধহয় ভেবে দেখা উচিত এটা এক ধরনের স্বার্থপরতা। সৃষ্টিকর্তার প্রতি, প্রকৃতির প্রতি, কাছের মানুষের প্রতি দায়িত্বজ্ঞানহীনতার লক্ষণ। কারণ আপনার মানসিক অসুস্থতা অন্যকে পীড়িত করে, আপনার কর্মক্ষমতাকে বাধাগ্রস্ত করে, আপনার পারিপার্শ্বিকতাকে অস্থির করে তোলে, আপনি নিজের জীবনকে ভারাক্রান্ত করে তোলেন এবং অন্যের প্রত্যাশাকে আহত করেন। সময় নষ্ট না করে নিজের প্রতি মনোযোগী হয়ে দেখুন জীবন অনেক বেশি আনন্দময় এক অভিজ্ঞতা।
আজকের প্রেক্ষাপটে প্রত্যেকেই নিজের ও অন্যের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি যত্নবান হতে হবে। আর এজন্য প্রথমে নিজের আবেগকে চিহ্নিত করতে হবে। দুঃখ, উদ্বেগ, উত্কণ্ঠার কারণগুলো খুঁজে বের করতে হবে। যথাযথ পদ্ধতিতে কারও না কারও কাছে এ অনুভূতিগুলোর প্রকাশ ঘটাতে হবে। প্রিয়জন, বন্ব্দু, ডাক্তার, ধর্মের ভালো ব্যাখ্যা দিতে পারেন এমন কারও কাছেও কিন্তু আপনি মনের অবস্থা খুলে বলতে পারেন। মন খুলে মনের কথা বলার মাধ্যমে অনেক চাপ কমে যাবে। এ বলতে পারার অভ্যাসটা শুধু বড়রাই রপ্ত করলে হবে না, শিশুদের মধ্যেও এ অভ্যাসটা গড়ে দিতে হবে; যাতে করে অভিযোগ না, মনের অবস্থা-অনুভূতি প্রকাশের জন্য শিশু মা-বাবাকে আসল মানুষ ভাবতে পারে।
ভারসাম্যপূর্ণ জীবনযাপন মানসিক সুস্থতার অন্যতম হাতিয়ার। সমস্যা আছে বলে সেটাতে আচ্ছন্ন হয়ে পড়বেন না। এর অর্থ এই নয় যে, সমস্যার মধ্যেও ‘সুখী’ ‘সুখী’ ভাব করবেন। গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির দিকে দৃষ্টিপাত করা।
মনকে বশ করার চেষ্টা না করে তাকে কীভাবে প্রফুল্ল রেখে জীবনকে আনন্দময় করে তোলা যায় চলুন জেনে নেই সেরকম কিছু টিপস।
--স্বাভাবিকতা বজায় রাখুন, আপনি যা নিজেকে সেভাবেই প্রকাশ করুন। ময়ূরপুচ্ছ সৌন্দর্য দিতে পারে, কিন্তু এতে অন্যের সমর্থন, আত্মবিশ্বাস, আত্মসম্মান ক্ষুণম্ন হয়।
--অন্যকে বিশ্বাস করুন, নিজের ওপর বিশ্বাস রাখুন।
--নিজের পঞ্চ ইন্দ্রিয়কে আনন্দিত রাখুন। ভালো গান শুনুন, ভালো ছবি দেখুন। ফুলের গন্ব্দ নিন, লেবু দিয়ে পানি পান করুন। নিজের শরীরের যত্ন নিন।
--সৃজনশীল কাজ বা উদ্যোগের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখুন। বাগান করুন, ছবি আঁঁকুন, লেখা ছাপা না হলেও লিখুন।
--বিশ্রামের সময়টাকে মূল্য দিন। আড্ডা, প্রাণখুলে হাসি, ভালো বইপড়ার মতো অভ্যাসে ভরপুর সময় কাটান।
--একাকিত্ব মানসিক চাপ বাড়ায়। নিজেকে সামাজিক কর্মকাণ্ডে অন্তর্ভুক্ত করুন। প্রতিদিন অন্তত একজনের উপকার করার চেষ্টা করুন। অন্যের সমস্যা, অন্যের কষ্ট অনুভব করুন।
--টিভি আর কম্পিউটার—স্কিদ্ধনের বাইরের পৃথিবীকে দেখুন। মানুষের সঙ্গে সামনাসামনি যোগাযোগ, অন্যের অভিজ্ঞতা জানার চেষ্টা করুন।
--দৈহিক সৌন্দর্য যেমনই হোক না কেন, অন্তরের সৌন্দর্য উপলব্ধি করুন। নিজের প্রতি যত্নবান হোন, নিজেকে ভালোবাসুন।
--মনকে প্রশান্ত রাখুন। জীবনের আসল ছন্দ লুকিয়ে থাকে দমের মধ্যে। গভীরভাবে শ্বাস নিতে শিখুন। মেডিটেশন করুন। প্রশান্তির পদ্ধতি হিসেবে নিয়মিত মেডিটেশন করুন।
--নিজের ভালোলাগাকে মূল্য দিন। দৈনন্দিন কাজের ফাঁকে এমন কিছু করুন, যা একান্তই নিজের আনন্দের জন্য।
--পৃথিবীতে নিজের অবস্থানের জন্য কৃতজ্ঞ থাকুন। যেসব কারণে আপনি শুকুরিয়া আদায় করেন তা ভালো করে ভেবে দেখুন। ধর্মীয় আচার পালন করুন। সৃষ্টিকর্তা বিশাল এ প্রকৃতির অংশ হিসেবে আপনাকে সৃষ্টি করেছেন, সেই প্রকৃতির সঙ্গে একাত্মতা অনুভবের চেষ্টা করুন।
অস্থিরতা নয়, একাগ্রতার মাধ্যমে নিজের মানসিক সুস্থতা নিশ্চিত করুন। প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন। তবে কে না জানে আত্মশক্তির চেয়ে শক্তিশালী ওষুধ আর নেই। সেই ওষুধেই ভালো হয়ে যাক আপনার মন।
No comments:
Post a Comment